মৌলভীবাজারে যত্রতত্র ইটভাটা

মৌলভীবাজারে পরিবেশ অধিদফতরের নীতিমালা উপেক্ষা করে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। ফসলি জমির পাশে এমনকি স্কুল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অনেক ইটভাটা।

ইট প্রস্তুত নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাহাড়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং লোকালয় থেকে তিন কি.মি. দূরত্বের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। এছাড়াও কৃষিজমিতে ইটভাটা তৈরির আইনগত নিষেধ থাকলেও কৃষিজমি, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বনাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা।

মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় ৭০টি ইটভাটার মধ্যে অর্ধেক ইটভাটায় কোনো অনুমতি নেই। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে কঠিন আইন থাকা সত্ত্বেও কিছুই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জেলার বিভিন্ন জায়গায় বাংলা ড্রাম চিমনির মাধ্যমে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়।
আবার কোনো কোনো জায়গায় চিমনি ছাড়াও ইট পোড়ানো হয়।

বেশিরভাগ জায়গায় কৃষি জমি নষ্ট করে গড়ে উঠছে ইটভাটা। যার কারণে ইটভাটার পার্শ্ববর্তী জমির কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশে ইটভাটা নির্মাণ করায় প্রতিনিয়ত শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ধুলা ও ধোয়ার মধ্যে চলাচল করতে হয়।

জেলার রাজনগর উপজেলার বেশিরভাগ ইটভাটা ফসলি জমি এবং জনবসতির ২০০ হাতের ভেতরে অবস্থিত। ইটভাটার কারণে ফসলি জমিতে ফসল হচ্ছে না ও বসতবাড়ি ছাই এবং ধুলোবালিতে ঢাকা পড়ছে।

স্থানীয় কৃষক আব্দুল মতিন জানান, ইটভাটার কারণে ফসল হচ্ছে না। অনেকের আবার চর্মসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে।

Brikfield-03

জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় স্কুলের পাশে ইটভাটা তৈরির হিড়িক পড়েছে। সরেজমিনে উপজেলায় ঘুরে দেখা যায়, কমলগঞ্জ বহুমুখী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ও কমলগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁষে কৃষি জমির ওপর একটি, জালালিয়া এলাকায় বেগম জেবুন্নেছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানার দু’পাশ ঘেঁষে কৃষিজমির ওপর একটি, লংঙ্গুর পার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অদূরে একটি ও মুন্সীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালিপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয় এবং সাজেদা বারি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের পার্শ্ববর্তী কৃষিজমির ওপর গড়ে উঠেছে বিশালাকৃতির আরও একটি ইটভাটা। এছাড়াও উপজেলার ফসলি জমিতে রয়েছে আরও ১০টি ইটভাটা। বিদ্যালয় ঘেঁষা ইটভাটাগুলোর প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী ছাড়াও হাটবাজার, লোকালয়ের কয়েক হাজার লোক ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ইটভাটায় কৃষকদের ফসল বিনষ্টের একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া ইটভাটাগুলোর কার্যক্রমের বিষয়েও খোঁজ নেয়া হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেক ইটভাটার পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেই। কেন নেই জানতে চাইলে একটি ইটভাটার ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের ব্যবসা করতে সমস্যা হচ্ছে না। তবে তারা অচিরেই করে নেবেন।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এ (যা ১ জুলাই ২০১৪ থেকে কার্যকর) বলা হয়েছে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। কৃষি জমি, পাহাড়, টিলা থেকে মাটি কেটে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতেও নিষেধ রয়েছে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন-২০১৩ এর ৮ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা; কৃষি জমি, পরিবেশ বিপর্যয়, ফসলের ক্ষতি সাধন, ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান দখল করে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। ভাটা মালিকরা এ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক ইটভাটা স্থাপন করে চলেছেন। যাদেরকে পরিবেশ অধিদফতর ছাড়পত্র দিচ্ছে তাদের বেলায়ও মানা হচ্ছে না আইনের বিধান।

পরিবেশ অধিদফতরে ইটভাটার ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের মতামত নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু তারা এ মতামত কখনও নেয় না।

এ বিষয়ে রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌসি আক্তার জাগো নিউজকে জানান, ইটভাটা পরিচালনার আইন ও নীতিমালা মেনে অনেকেই ভাটা পরিচালনা করছেন না। শিগগিরই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জেলা কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শাহজাহান জানান, নির্দিষ্ট আইন থাকার পরেও আইন মানা হচ্ছে না। যার ফলে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। সামাজিক সচেতনতা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ একমাত্র সমাধান হতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজারের সমন্বয়ক আ.স.ম সালেহ সোহেল জানান, জেলায় প্রায় ৭০টি ইটভাটা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেক ভাটার আইনি বৈধতা নেই, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেই। এসব ভাটাকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।